শিল্পভাবনা ১: হৃদয়বৃত্তি

শিল্প বা আর্ট কীভাবে শিল্প হয়ে ওঠে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার অন্ত নেই। শিল্পের ধরণ অনুযায়ী তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা আছে। তর্ক আছে যেমন কুতর্কও আছে। 'সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি' থেকে কল্পনাকে বলতে গেলে অচ্ছুত করে দিয়ে 'রিয়ালিজম'-এর চর্চাও আছে।

সেসব বাদ দিয়ে মোটাদাগে ভাবলে, শিল্প হচ্ছে শিল্পীর নিজের সত্য (রবীন্দ্রনাথকে প্যারাফ্রেজিং করলে এই দাঁড়ায়)। সংস্কৃত সাহিত্যের ধারায় শিল্পীর মনের একটা 'ভাব' থাকে, বাহ্যিক বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয় থেকে 'রস' এসে সেই ভাবটিকে প্রভাবিত করে নতুন ভাবের জন্ম দেয়। তার প্রকাশ হলো শিল্প। এই পর্যন্ত ধরলে শিল্প হৃদয়বৃত্তি। তবে আমি মনে করি শিল্পে বুদ্ধিবৃত্তির একটা বড় জায়গা আছে। একথা অনেকেই মানতে নারাজ। তবে আজ পর্যন্ত যারা তাদের কাজ দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে, ধরে রেখেছে কয়েকশো বছর তাদের মধ্যে পথভ্রষ্ট, শয়তান সকলরকমের শিল্পী-সাহিত্যিক দেখেছি, মূর্খ একটিও দেখিনি।

সে বুদ্ধিবৃত্তির আলোচনা পরে করা যাবে। আমরা আপাতত হৃদয়বৃত্তির দিকে দেখি। শিল্পীর হৃদয়বৃত্তি আর দশজনের হৃদয়বৃত্তির মত না। অনুভূতির মূল যন্ত্রপাতি, মানে মস্তিষ্কের পুরনো অংশ আমরা আমাদের সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী জ্ঞাতির সাথে শেয়ার করে এসেছি। আমাদের হিংসা কুমীরের থেকে কিছু একটা আলাদা না। সন্তানের প্রতি ভালোবাসায় বাবা-মা শিম্পাঞ্জির মতই। শুধু প্রকৃতিপ্রদত্ত অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল হলে এই হৃদয়বৃত্তি বেশিদিন চালানো যায় না।

তো শিল্পীর একধরণের যত্ন করে গড়ে তোলা হৃদয়ের প্রয়োজন পড়ে। তার মূলে থাকে একধরণের বোধ। সে কেমন বোধ? জাপানিজরা সেই বোধকে বলে 'mono no aware'। জীবন ও জগতের প্রতি একধরণের বিস্ময়পূর্ণ দুঃখবোধ। একদিন হঠাৎ ভোরে সূর্যোদয়, অথবা আশ্বিনের রাতের আকাশের গাঢ় নীলে অজস্র তারা, কিংবা হঠাৎ একদিন সোডিয়াম বাতির নীচে দাঁড়ালে, কাজের শেষে, জাগতিকতার শেষে হঠাৎ মুখ থেকে যে 'আহ্' বেরিয়ে আসে, কিংবা সারি সারি মৃত্যু, জীবনের অপচয় দেখে যে দুঃখবোধ হয়- গভীর ও ইন্দ্রীয়াতীত, সেটাকে গ্রহণ করার ক্ষমতাই শিল্পীর হৃদয়বৃত্তির মূল বিষয়।

বিস্ময় বলতে গেলে শিল্পের শেষ কথা। আপনি হয়ত বলতে পারেন যেই বিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন 'কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে' তার সাথে বাশোর হাইকুর হয়ত মিল আছে, গঘ্ এর স্টারি নাইটের মিল আছে, কিন্তু কাফকা? কাফকার আছে জীবনকে খুব গভীরভাবে দেখার ক্ষমতা এবং বিস্ময়বোধ। আমলাতন্ত্র আমাদের বিস্মিত করে না, কদাকার লাগে না বেশিরভাগ সময়, কাফকাকে বিস্মিত করেছিল।

তা বাদে মানুষ লিখে বা এঁকে বাহবা পায় না এমন না। শুধু বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে আমরা বলি বাহ্! কিন্তু দ্বিতীয়বার আর তার কাছে ফেরা হয় না। ফিরতে হয় জীবনানন্দের কাছে, কাফকা, রবীন্দ্রনাথ, মানিকের কাছে। দেখতে হয় আরেক মানিকের সিনেমা, শুনতে হয় বাখ্।