সময়ের সাথে সংগ্রাম

বিজ্ঞান ও দর্শনের সবচেয়ে প্রাচীন ভাবনাগুলোর একটি হচ্ছে 'সময়'। 'সময়'-এর রূপ ও আচরণের অনেকগুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তো আছেই, গত কয়েক দশকে সময়কে একেবারে আনকোরা নতুনভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা চলছে। কখনো বাস্তবতার একটি মাত্রা হিসেবে, কখনো বা এন্ট্রপির ফলাফল বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে। অবশ্য সময়ের এইসব ব্যাখ্যা আমরা গাণিতিক ও ব্যবহারিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারলে, সাদামাটা জীবনে সময়ের এই চেহারাগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। মানুষ সময়কে সরলরৈখিকভাবেই অনুভব করতে অভ্যস্ত। মানুষ অভ্যস্ত এটা জেনেও যে সময়ের ব্যবহারযোগ্যতা থাকলেও বস্তুত তার সময়ের ওপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মোটের ওপর আমরা সময়ের দাস। সময়ের এই দাসত্বকে আমি 'সময়বাধ্যতা' (temporality of being) বলবো। এই অভ্যস্ততা আমাদের গোটা জীবনকেই প্রভাবিত করে, আমাদের দর্শন, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও জীবনবোধে সময় একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রাখে।

যা কিছু আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি না, তার প্রতি আমাদের একরকম ভয়, নিদেনপক্ষে অস্বস্তি কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই, সময়বাধ্যতা আমাদের ভীত করে। এই ভীতির আমরা সবচেয়ে পরিপক্ক অবস্থায় দেখি মৃত্যুভীতি হিসেবে। মৃত্যু আমাদের সময়বাধ্যতার সর্বশেষ নিদর্শন। মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের সময়বাধ্যতা শেষ হয়, সাথে সাথে জীবনও। মৃত্যু থেকে পালানো বা অতিক্রম করার আমাদের যে জৈবিক প্রবৃত্তি, তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশ হচ্ছে সময়বাধ্যতাকে অতিক্রমের সকল পুরাণসমূহ (Myth)। মৃত্যু (এবং সময়বাধ্যতা) অতিক্রমের সবচেয়ে পুরাতন পুরাণগুলো আত্মা-সম্পর্কিত। প্রথমদিকে মৃত পূর্বপুরুষের ভুত থেকে পরে আত্মার ধর্মতাত্ত্বিক সকল ধরণের আত্মার মূল যোগ্যতা তার অবিনশ্বরতা। তার সাথে সমাজব্যবস্থার কাঠামোগত জটিলতা থেকে ক্রমে এসেছে মৃত্যুপরবর্তী বিচার এবং বিচার পরবর্তী শাস্তি ও পুরষ্কার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসেছে জন্মান্তর, এমনকি মহাবিশ্বেরও পুনর্জন্ম।

সময়ের সাথে সাথে পুরাণগুলোর বাহক ধর্মগুলো টিকে গেলেও দর্শন ও বিজ্ঞানের কাছে সেগুলো গ্রহনযোগ্যতা হারিয়েছে। ফলত, মৃত্যু অতিক্রম করার পৌরাণিক সকল পদ্ধতি এখনকার বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা মেনে নিতে পারে না। এমনকি, সক্রিয়ভাবে বিজ্ঞানমনষ্ক না হলেও, অনগ্রসর সমাজগুলো ছাড়া এই পুরাণগুলি এখন আর আধুনিক মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। মোটের ওপর বলা চলে, এগুলি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।[1]


  1. The Power of Myth by Joseph Campbell ↩︎