আমার শহর
পৃথিবীর আর দশটা দেশের মাপকাঠিতে যাকে শহর বলা চলে খুলনা বোধহয় তা না। বিভাগীয় এই শহরটিকে মফস্বল বললে খুব একটা মানহানি হয় না তার। এর গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে দূরত্ব সময়ের হিসেবে ঘন্টা পেরোয় না।
আমি এই শহরে জন্মেছি ও বেড়ে উঠেছি। শহরটা আমার মজ্জাগত, আমার নাগরিকতা এই শহরের ছাঁচে ঢালা। ব্রিটিশ ভারতে কোলকাতার 'ভদ্র' বাবু এবং দুষ্টু সাহেবরা আসতেন ভৈরবের তীরে বড়বাজার সংলগ্ন এলাকায়, দেহপসারিণীদের কাছে। বাবু সমাজে একজন-দুজন রক্ষিতা রাখা নৈমিত্তিক হলেও একটা জাত ছিল শুনেছি যারা এটা রাখতে লজ্জা পেতেন। তাই এই গ্রাম্য নগরে তাদের পদধূলি পড়ত। সেই থেকে বড়বাজারের পত্তন, শহরের প্রসার। সে আমার যুগ না। আমি জন্মেছি বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ সীমান্তে। পৃথিবীর প্রবল ঘুর্ণনে ছিটকে পড়েছি একবিংশের গোড়ায়। আমার চেতনায় বিংশ আছে ছায়া হয়ে, একবিংশ ভাস্বর।
জন্ম থেকে কৈশোর কেটেছে দক্ষিণ খালিশপুরে। খালিশপুর খুলনার মূল শিল্প এলাকা ছিল। আমার শৈশবেই খালিশপুরের মিলগুলো একটা একটা করে বন্ধ হয়ে গেলো কয়েকদিনের মধ্যেই। কর্মহীন মানুষ ক্রমে সম্বল হারিয়ে নিরন্ন হলো। কোনো একটা সময় কেউ লঙ্গরখানাও খুলেছিল বলে শুনেছি। আস্তে আস্তে শহরটা ফাঁকা হয়ে গেলো। একটা জমজমাট ভাব, সর্বদাই একটা শহুরে গুঞ্জন বন্ধ হয়ে গেলো। ওই এলাকায় যাতায়াত ছিল কম। তাই, মিলগুলোর মোড়ে ছুটির সময়কার জনসমুদ্র আমার কাছে কেবল শোনা কথা। একটু বড় হয়ে শুধু তার ধ্বংসাবশেষ দেখেছি। মিল, চিত্রালি এবং হাউজিং বাজার। তাও জমজমাটির কমতি নেই।
পড়তাম রোটারী স্কুলে, খালিশপুর এলাকায় নামডাকওয়ালা স্কুল বলা চলে। সংলগ্ন একটা সরকারি গ্যারেজ ও অন্য আরেকটি স্থাপনা, কয়েকটা গুদামঘরের মত দেখতে। গ্যারেজে সারিসারি নষ্ট জীপ, ক্রেন, রোলার, পাশে সিমেন্টের পাইপ, পীচের ড্রাম এবং গুদামের পাশে কোনো একটি ম্যানহোলে একটি মেয়ে কবে পড়ে মারা গিয়েছিল তার অতৃপ্ত আত্মা (অতৃপ্তি বোধহয় আইসক্রিম বা চটপটির) এইসব নিয়ে বেশ একটা রোমাঞ্চকর ছিল পরিবেশ।
আমার সময়ে শহরের মূল উপজীব্য জীর্ণতা। সময় এবং ইমারত দুটোরই। পরিচিতদের মুখে শোনা এই সেদিন শেয়াল দৌড়নো মাঠে বা বড় পুকুর ভরাট করে দালান তোলার কাহিনী। কোনোকিছুই ঠিক সাজানো-গোছানো নয়, কোনো কিছুই এমন নেই যাকে ঠিকঠাক সুশ্রী বলা চলে। নতুন স্থাপনাগুলোও বুঝি কয়েকদিনেই শহরের ধূসরতা গা ঢাকা দেয়। মানুষগুলোও তেমন, অগোছালো। এমনকি গুছিয়ে ওঠার তাগিদ বা ইচ্ছা কোনোটাই বুঝি নেই। তারা গাছাড়া রকমের উদারও বটে। পাঁচটাকার ভাড়ায় তিনটাকা নিয়ে নেন এমন নিস্পৃহতায় যেন জাগতিক সকল দায় থেকে নির্বাণ লাভ করেছেন। বস্তুত, গরীবেরও গরীব তারা। আমার কৈশোর তেমন সময়েই কেটেছে। সারি সারি অনুচ্চ ভবন, মাঝেমধ্যে কোনোটা খুব বেশি পুরনো, গত শতাব্দীর বনেদিয়ানার ভগ্নাবশেষ। মিল বন্ধ হওয়ার পর অল্পই মানুষ শহরে। চলতে গেলে গায়ে ধাক্কা লাগে না, দ্রুত চলার তাগিদ নেই, কিছু করার স্পৃহা নেই। পুরো শহরটা যেন তন্দ্রার ভেতর।
শহরের সংস্কৃতির পতাকাবাহীরা আর সব জায়গার মতই। দিবস ধরে ধরে তারা প্রোগ্রাম করেন। একটা বইমেলাও হয় ফেব্রুয়ারিতে, প্রতিবছর বইয়ের দোকান কমে কমে কসমেটিকসের দোকান বাড়ে। মানুষের কাছে বেশ মজার একেকটা ব্যাপার এসব। মজাটা কেটে গেলে আবার ঢিমে তালে জীবন চলে।
যে সময়টার কথা বলছি, অর্থাৎ আমার শৈশব ও কৈশোর, সেসময়ে আমার এমনটা লাগেনি। কেননা তুলনীয় কিছু ছিল না। চাকরিসূত্রে কিছুদিন ঢাকায় থেকে এসে আমি শহরের এই দিকগুলো আবিষ্কার করেছি একরকম। পামুকের মত এক উজুন ভর করেছে আমার ওপর। এবং ইস্তানবুলের মত এই উজুন আমার ব্যক্তিগত নয়। এই শহর আমায় এমন হতে বাধ্য করছে এ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আমার শৈশবে বা কৈশোরে নয়, ঠিক এখন আমি স্মৃতিকাতর।
আমি আর দশজনের মত ব্যক্তিগত স্মৃতিকাতরতার কথা বলছি না। এ শহরকেন্দ্রিক। আমার স্মৃতির অগোছালো শহরটা এখন গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। পদ্মায় একটা সেতু হবে এই গুঞ্জন শুরু হতে না হতে ব্যবসায়ীদের চোখ পড়ছে এদিকে। শহরের উন্নতি হচ্ছে, স্কাইস্ক্র্যাপার উঠছে, হালফ্যাশানের বিপণি, রেস্তোরাঁ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আউটলেট, রাস্তায় অনেক বেশি গাড়ি সব মিলে শহরটা যাচ্ছে বদলে। বছরদশেক পর শহরটার সাথে কিছুতেই তার দরিদ্রবেশের মিল পাওয়া যাবে না।
এ তো গেলো স্মৃতি ও ভবিষ্যতের পার্থক্য, কাতরতাটুকু অন্যখানে। এই দরিদ্র শহরের সাথে আমার এক গভীর প্রেম ছিল। মনে পড়ে, সদ্য কৈশোরে এক যন্ত্রণা অকারণেই মাথায় চেপে বসত। আবছা আলোর বা আলোহীন রাস্তাগুলোয় আমার বহু সন্ধ্যা কেটেছে। আমি নিজেকে চিনতে চেয়েছি। বাজার, মানুষজন পেরিয়ে একেকটা ফাঁকা রাস্তায় সোডিয়াম বাতির নীচে দাঁড়িয়েছি আর প্রতারক আলো আমার রঙ দিয়েছে বদলে। উপহাস করেছে। বহুদিন আমি সকালে শুধু রোদ মাখতে রাস্তায় নেমেছি। সবকিছুতেই একরকম স্বাচ্ছন্দ্য ভর করত। তবু সবকিছুতেই এক মনখারাপি। সেই বুঝি প্রেমিক হয়ে ওঠা। বুকের ভেতর একটা তার বাঁধা হলো কোমলগান্ধারে।
মনে পড়ে, তবু স্নেহার্দ্র শহরটা তার মলিনতা নিয়ে, সাদামাটা মানুষজন আর নিস্তরঙ্গতার ইশারায় বারবারই বোধিবৃক্ষের নীচে বসিয়েছে। আমি কবিতা লিখতে শিখেছি। সেইসব দিনে অগোছালো দোকানে ঢুকে আধ-নোংরা গ্লাসে জল খেতে অগোছালো আমাকে মোটেও অদ্ভুত ঠেকতো না। ঝা-চকচকে নতুন শহর তার পুরনো প্রেমিককে দেখে যদি না দেখার ভান করে তা আমার কাছে যতই ব্যথার হোক না কেন, তার কাছে বেঁচে থাকার প্রশ্ন। পরিষ্কার টাইলস্ বাঁধানো ফ্লোরে আমার পদধূলি কাম্য নয়।
আমি আমার পরিচিত শহরটাকে আমার "শহরনামা" সংকলনে ধরে রাখতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছি। তবুও এই লেখাটার চেয়ে সেগুলোর ব্যর্থতা বোধহয় কম। কেননা, যা বলতে চাই তা গদ্যে কিছুতেই বলতে পারি না আর কবিতায় তা না বলেই আভাসটা দেওয়া যায়। বস্তুতঃ শহরটা আমার কাছে নারীর রূপে ধরা দিয়েছে বারবার। মানিনী, মোহময়ী, চিরপরিচিতা। যেমনটা ছিল শহরনামার প্রথম কবিতায়:
এই শহরেই, এই শহরের মতই একজন নারীকে আমি ভালোবেসেছি। সেও আমার সময়ের মানুষ। অথচ, শহরের মত একটু প্রাচীনপন্থীও হয়তবা। তারও অনেক পরিবর্তন এসেছে সময়ের সাথে। এই শহরেই আমি তাকে প্রণয়ের কথা বলেছি,
বাতিগুলো মেপে মেপে
সাজালো কে আমার শহরে?
ফাঁকে ফাঁকে জমে আছে ঘন
ততটা অন্ধকার
যতটা আমার প্রয়োজন
বলে দিতে প্রণয়ের কথা
এঁকে দিতে কাতরতা-গ্রাফিটি আমার
তার সাথে ভাগ করে নিয়েছি শহরটা। বহু সন্ধ্যা এবং ভোর, অনেকগুলো দিন আমরা শহরটার অলি-গলি, পার্ক-ক্যাফেতে, রিকশায় কাটিয়েছি। কত বৃষ্টি-ঝড়, হঠাৎ আবিষ্কৃত পুকুরপাড়… শহরটা সঙ্গেই ছিল। একসময়, তাকে জীবনের প্রয়োজনে দূরে যেতে হয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি শহরটা তার কাছে পৌঁছে দিতে:
শহর কি ততটাই যতটুকু চোখে দেখা যায়?
ছুঁলে হাত
সেও বয়ে নিয়ে যায় আমার শহর।
মাঝরাতে যদি
চিবুকে গড়ায় তার জল,
মুছতে না মুছতেই চেয়ে দেখি
মহাপ্লাবনের বেগে ভেসে গেছে
শহর ও শরীরের গলিঘুঁজি পথ।
আমি নুহ নই, তাই ডুবি
বেছে নিই নির্বাণ সর্বনাশের। (বৃষ্টি)
একটাকার 'পেপসি' আইসক্রিম বা দুটাকার চটপটি পালিয়েছে বহুদিন হলো(রবীন্দ্রনাথের গোলাপি রেউড়ির মত)। হতদরিদ্র, অগোছালো শহরটাও তার খোলস বদলে ফেললো বলে। আমার মত মানুষ যারা সহজে ভালোবাসা বদলাতে পারে না তারা কাতর হবে। পৃথিবীর মহাযজ্ঞে তারা সংখ্যালঘু। শহরটা তার আলুথালু চুলের মত সরুসরু রাস্তাঘাট আর আবছা আলো নিয়ে সরে পড়বার আগে আমি রোজ তার কাছে যেতে চাই। খুব চেনা এই শহরটাকে আরেকটু চিনতে চাই: